Saturday, March 29, 2014

জলবায়ু সম্মেলন ২০১২ : আশার চেয়ে হতাশা বেশি -গোলাম মোর্তোজা, দোহা থেকে

গোলাম মোর্তোজা, দোহা থেকে
মরুভূমির দেশ কাতার। তেল-গ্যাসের দেশ কাতার। ১৮ লাখ মানুষের বাস পুরো দেশে। পানির চেয়ে তেলের দাম কম। কাতারিদের বার্ষিক গড় আয় ১ লাখ ডলারের ওপরে। মরু শহর দোহায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন ২০১২। মরুভূমি মানেই তীব্র গরম। তবে কাতারে সম্ভবত সবচেয়ে ভালো সময়ে জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এখন কাতারে শীতকাল। মাঝেমধ্যে সামান্য বৃষ্টিরও দেখা মিলছে। দিনে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। দূষণমুক্ত বাতাসে রাস্তায় হাঁটলে তেমন একটা গরম অনুভূত হয় না। সন্ধ্যা থেকে হালকা শীত। তাপমাত্রা থাকে প্লাস মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 
জলবায়ু সম্মেলন উপলক্ষে দোহায় এসেছে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। প্রতিটি হোটেল পরিপূর্ণ। কোথাও কোনো রুম খালি নেই। ৫০ ডলারের হোটেল ভাড়া ২০০ ডলারে ঠেকেছে। অবিশ্বাস্য রকমের বড় কাতার সেন্ট্রাল কনফারেন্স সেন্টারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন ২০১২।
বিশাল বড় কনফারেন্স সেন্টারের সম্মেলনে যথারীতি এ বছরও বিশাল বড় প্রতিনিধি দল এসেছে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশ দলের প্রতিদিনের সমন্বয়সভায় বিষয়টি সবাই স্বীকারও করছেন। একজন উপসচিব বার বার বলছিলেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশ অনেক বড় দল নিয়ে এসেছে তাই আমাদের সব কমিটিতে উপস্থিত থাকা উচিত।’
এই কথার মধ্য দিয়েই পরিষ্কার হয় সব জায়গায় সমানভাবে উপস্থিতি থাকছে না বাংলাদেশের। উপস্থিতি থাকলেও বিভিন্ন পর্যায়ে সমঝোতা বিষয়ক কমিটিগুলোর কোনোটিতেই গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে নেই বাংলাদেশ। অথচ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের একটি।
বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ছোট দেশ বিভিন্ন কমিটির চেয়ার হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। যদিও তারা বাংলাদেশের চেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ছোট পাঁচ সাত জনের প্রতিনিধি দল নিয়ে এসেছে তারা।
বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এখনও আসেননি। এই লেখা যখন পাঠকের হাতে যাবে তার আগেই তিনি দোহায় এসে পৌঁছাবেন। বাংলাদেশের সমঝোতা দলের প্রধান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ। তিনি সমন্বয়ের চেষ্টা করছেন। কে কোন আলোচনায় উপস্থিত থাকবেন সেই নির্দেশনা দিচ্ছেন প্রতিদিন সকালে। কে কি করে আসলেন, কোন বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কি, সেটা সন্ধ্যার মিটিংয়ে আলোচনা করছেন। বাংলাদেশ সমঝোতা দলে বেশকিছু যোগ্য মানুষ আছেন। কিছু অযোগ্য মানুষও আছেন। যোগ্যদের কারও কারও দেশের প্রতি কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন আগেও ছিল, এখনও পরিলক্ষিত হচ্ছে। তারা দেশের পরিচয় বহন করে নিজের, নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্যে কাজ করছেন। কে কোন যোগ্যতায় সমঝোতা দলের অংশ হয়েছেন, তার কোনো মানদণ্ড নেই। 
বাংলাদেশ সবচেয়ে বাজে নজির তৈরি করেছে সরকারি প্রতিনিধি দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে ‘পার্টি’ ব্যাজ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মই অনুসরণ করা হয়নি। গালভরা নামসর্বস্ব একটি এনজিও, যার কর্মী তিনি নিজেসহ দুজন। দুজনই ‘পার্টি’ ব্যাজ নিয়ে সম্মেলন স্থলে ঘুরছে। যার ‘পার্টি’ ব্যাজ পাওয়ার কোনো কারণ নেই। সবাইকে খুশি রাখার এক অদ্ভুত নীতিতে চলছে বাংলাদেশ। কোপেনহেগেন, কানকুন, ডারবানে একই চিত্র দেখা গেছে। এবারের প্রতিনিধি দল অন্যান্যবারের তুলনায় একটু ছোট হলেও ‘পার্টি’ ব্যাজের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
২.
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ উন্নত দেশগুলো। আর বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত। যাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং ক্ষতির কারণ কার্বন নির্গমন কমাতে হবে। ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটোতে যে সম্মেলন হয়েছিল সেখানে এ বিষয়ক একটি চুক্তি হয়েছিল। যা পরিচিত ‘কিয়োটো প্রটোকল’ নামে। যার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে এ বছর। উন্নত দেশগুলো যে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য কিয়োটো প্রটোকলই তার একমাত্র আইনগত ভিত্তি। কানকুনে, তার আগে কোপেনহেগেনে এবং গত বছর ডারবানে আসলে আইনগত কোনো চুক্তি হয়নি। তাই কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ বাড়াতে হবে, এই দাবি গত কয়েক বছরের। এবারের সম্মেলনেও বিষয়টি শুরু থেকেই জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে।
দোহা সম্মেলনের শুরুতেই ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ আগামী পাঁচ বছরের জন্যে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। স্বল্পোন্নত দেশগুলো যা সমর্থন করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ আট বছরের জন্যে বাড়ানোর কথা বলছে। এখন পাঁচ বছর না আট বছর এটা নিয়ে বিতর্ক চলছে। অনেকে এটাকে বলছে সময়ক্ষেপণের অনাবশ্যক বিতর্ক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। পাঁচ বছর না আট বছর বাংলাদেশ কি চায় তা এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি। দেশে বিদেশে কোথাও আমাদের সমন্বয় নেই।
রাশিয়া, জাপান, কানাডা, নিউজিল্যান্ড কিয়োটো প্রটোকলের বিষয়ে আগে থেকেই অনাগ্রহী। পাঁচ বছর আট বছর যাই হোক তারা কিয়োটো প্রটোকলের বাইরে থাকবে। দোহাতেও তারা এই অবস্থান ইতোমধ্যে পরিষ্কার করেছে। ফলে কিয়োটো প্রটোকলের গুরুত্ব এমনিতেই অনেক কমে গেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, ব্রাজিল ও চীনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ব্রিকস গ্রুপ কার্বন কমানোর কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি নয়। অর্থাৎ কিয়োটো প্রটোকলের প্রতি কারও কোনো আগ্রহ নেই। এখন প্রশ্ন কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ বৃদ্ধি বা দ্বিতীয় ধাপ কী হবে? এখন পর্যন্ত যা বোঝা যাচ্ছে কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ বৃদ্ধির একটি ঘোষণা এবার আসবে। তবে সেই ঘোষণার আইনগত ভিত্তি থাকবে না অথবা খুব দুর্বলভাবে থাকবে। এই প্রটোকলের আওতায় এসে উন্নত দেশগুলো ক্ষতিপূরণ বা কার্বন কমানোর সুনির্দিষ্ট বা বাস্তবভিত্তিক কোনো প্রতিশ্রুতি দেবে না। কেউ কেউ বলবে আমরা কার্বন কমাব। কত সালের মধ্যে কী পরিমাণ কার্বন কমানো হবে সেটা স্পষ্ট করে কেউ বলবে না। কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র তো কিয়োটো প্রটোকল মানবেই না। যা আগেই লিখেছি।
৩.
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়  ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান। সিদ্ধান্ত হয়েছিল ‘ফার্স্ট স্টার্ট তহবিল’ নামে একটি তহবিল করবে উন্নত দেশগুলো। সেটা করা হয়েছেও। কিন্তু অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন অরাজকতা। যারা সবসময় স্বচ্ছতার কথা বলে তারা এক্ষেত্রে চরম অস্বচ্ছ। এই অস্বচ্ছ নামের তালিকায় আছে ইইউ, সুইজারল্যান্ড, জাপান, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশ। গবেষণায় দেখা গেছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এসব দেশ অর্থ প্রদানের তথ্য দিচ্ছে। ফার্স্ট স্টার্ট তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাওয়ার কথা ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার। হিসাবে দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে ছাড় করেছে মাত্র ৩৩%। এ হিসাব অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের। অন্য আরেকটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে অর্থ ছাড়ের পরিমাণ মাত্র ২৫%। কিন্তু উন্নত দেশগুলো প্রচার করছে তারা ইতোমধ্যে ৩৩ বিলিয়ন ডলার অর্থ দিয়ে দিয়েছে। কীভাবে, কাকে কত অর্থ দিয়েছে তার সঙ্গে এই তথ্যের কোনো মিল নেই।
এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল টিআইবির জলবায়ু অর্থায়ন প্রকল্পের সমন্বয়ক এম জাকির হোসেন খানের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আইআইইডির সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে জলবায়ু অর্থায়ন প্রতিবেদন প্রকাশে উন্নত দেশগুলো কাক্সিক্ষত স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে পারেনি। স্বচ্ছতার সূচকে শিল্পোন্নত ১০টি দেশের মধ্যে তুলনামূলক অবস্থানে সুইজারল্যান্ড ১০০’র মধ্যে ৬৭% পেলেও ০% পেয়ে সর্বনিম্নে অবস্থান করছে নরওয়ে। তারা এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। স্বচ্ছতার মাত্রায় ৫০% এর নিচে অবস্থান করছে আইসল্যান্ড ৪৪%, নিউজিল্যান্ড ৪০%, জাপান ৫৫%, ইইউ ৪০%, কানাডা ৩৫%, যুক্তরাষ্ট্র ২৯%। এ অস্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ছে শিল্পোন্নত দেশগুলো। তারা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে এড়িয়ে যাচ্ছেন।’
এ তথ্যগুলো থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুত অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে দিতে চায় না। টালবাহানা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া তারই প্রমাণ। ইক্যুইটি বিডির প্রধান সঞ্চালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলছিলেন, ‘ফার্স্ট স্টার্ট তহবিল আসলে এখন ফলস স্টার্ট তহবিলে পরিণত হয়েছে। যারা আমাদের স্বচ্ছতা শেখাতে চায় তারা এখন সবচেয়ে বেশি অস্বচ্ছতার পরিচয় দিচ্ছে। যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। দেশে-বিদেশে সোচ্চার হতে হবে। আমরা সেই কাজই করছি।’
অর্থ দেয়ার হিসাবের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো খুবই হীনম্মন্যতার পরিচয় দিচ্ছে। কথা ছিল জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির কারণে যে অর্থ দেয়া হবে, তা হবে ‘নতুন’ এবং ‘অতিরিক্ত’। অর্থাৎ পূর্বে দেয়া প্রতিশ্রুত সহায়তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু এখন হিসাব দেয়ার ক্ষেত্রে সব রকম সহায়তাকেই তারা জলবায়ুজনিত ক্ষতির কারণে দেয়া বলে দেখাচ্ছে। যা খুব বড় মাপের প্রতারণা। প্রতারণার, এখানেই শেষ নয়। পুরো অর্থ দেয়ার কথা ছিল অনুদান হিসেবে। কোনোভাবেই ঋণ নয়। অদ্ভুত ব্যাপার মাত্র ৪৫% অর্থ দেয়া হচ্ছে অনুদান হিসেবে আর ৫৫% দেয়া হচ্ছে ঋণ হিসেবে যা পূর্বে দেয়ার প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি বরখেলাপ। উন্নত দেশগুলোর এই প্রতারণামূলক কাজে সহযোগিতা করছে বিশ্বব্যাংকের মতো জনবিরোধী প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাংক আবার এ কাজে ব্যবহার করছে দুর্নীতিপরায়ণ কিছু দেশকে। এর মধ্যে বাংলাদেশ আছে, প্রথম দিকেই আছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চুপিসারে ঋণ নিয়েছে। ঋণ নিয়েছে আরো কিছু দেশ। পর্যবেক্ষকদের ধারণা অসৎ সরকারগুলো যে কোনো উপায়ে অর্থ চায় নিজেদের জন্য, দেশের জন্যে নয়। ঋণ নেয়ার এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধি দলের ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। ড. কাজী খলীকুজ্জমান ঋণ নেয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু কিছু আমলা এবং রাজনীতিক ও প্রতিনিধি দলে থাকা স্বীকৃত বিশ্বব্যাংকের অনুচররা ঋণ নেয়ার পক্ষে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় কিছুসংখ্যক কমিটমেন্টহীন অসৎ ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
৪.
বাংলাদেশ সমঝোতা দলে দীর্ঘদিন ধরে বেশকিছু ব্যক্তি প্রতিনিধিত্ব করছেন। এক অর্থে এটা ভালো দিক যে, তারা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছেন। দেশের কাজে তা প্রয়োগ করছেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উলটো। এসব ব্যক্তি মনে করে নিয়েছেন, তারা দেশের একমাত্র বিশেষজ্ঞ। তারা ছাড়া আর কোনো সমঝোতাকারী বা বিশেষজ্ঞ নেই। এরা এক ধরনের মনপলি তৈরি করে নিয়েছেন। এত বছর পরে এসে একটি বিষয় এখন খুব পরিষ্কার করে বলার সময় এসেছে যে, এসব বিশেষজ্ঞ সমঝোতাকারীর কাছ থেকে দেশের আর কিছু পাওয়ার নেই। নতুন, তরুণ, দেশের প্রতি দায়বদ্ধ সমঝোতাকারী প্রয়োজন। এখনকার সবাইকে না হলেও তিন-চার জনকে বাদ দেয়াটা অতি জরুরি। বিশেষ করে কনসালটেন্ট এবং ‘দোকান’র মালিক হিসেবে পরিচিত যারা। দু-একজন আমলার পরিবর্তনও অতি জরুরি। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে একই পদে থেকে এ সেক্টরকে যারা দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আশ্রয় হারানো মানুষের কথা জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর আরো কিছু সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে (বক্স প্রতিবেদন)।
৫.
সম্মেলন শেষ হতে আরও কয়েকদিন বাকি। কিন্তু হতাশা সর্বত্র। কিছুই হলো না, কিছুই হবে নাÑ রব উঠেছে প্রথম থেকে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তারা মূলত উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থ পেতে চাইছে। অর্থ পাওয়ার ব্যাপারে তারা যত আগ্রহী, কার্বন কমানোর দাবির প্রতি অতটা সোচ্চার নয়। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর এটা সঠিক অবস্থান নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কমবেশি অর্থ কিছু পাওয়া যাবে। সেই অর্থ নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি হবে। সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্তরা সেই অর্থ পাবেন, এমনটা দুরাশা। আর কার্বন যদি কমানো না হয়, দূষণের মাত্রা বাড়তেই থাকবে। তাই বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উচিত অর্থের চেয়ে কার্বন কমানোর দাবি জোরালো করা। সারাক্ষণ অর্থ অর্থ করে চিৎকার করে কার্বন কমানোর আসল বিষয় চাপা পড়ে যাচ্ছে।
আর একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অবস্থান পরিষ্কার নয়। দেশ থেকে আসার আগে বাংলাদেশ ঠিক করে আসেনি কোন বিষয়ে তার অবস্থান কী। কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ পাঁচ বছর না আট বছর বাড়ানোর পক্ষে বাংলাদেশ? এই প্রশ্নটি বাংলাদেশ দলের তিনজন সমঝোতাকারীকে করেছিলাম। তারা কেউ পরিষ্কার নয়, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কী, একেকজন একেক কথা বলেছেন।
অনুদান এবং ঋণ নেয়া বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কী? এই প্রশ্নের উত্তরে সমঝোতা দলের প্রধান ড. খলীকুজ্জমান বললেন, ‘আমি ঋণের বিরুদ্ধে।’
বাংলাদেশ তো ঋণ নিয়ে নিয়েছে? 
‘এটা খারাপ হয়েছে। ঠিক হয়নি। আমি আগেই বলেছি।’
বাংলাদেশ দলের সমঝোতাকারীরা বলছেন এই ঋণ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় নেয়নি, নিয়েছে ইআরডি। আমরা জানতাম না। তাদের কথা শুনলে মনে হয় ইআরডি সরকারের বাইরের কোনো অংশ!
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবীর বলছিলেন, ‘অনেক হতাশা আছে। এর মধ্যেও এবারের সম্মেলনের কিছু প্রাপ্তিও আছে। বিশেষ করে জেন্ডার ব্যালেন্সের ক্ষেত্রে ভালো অগ্রগতি হয়েছে বলে আমি মনে করি। বিভিন্ন কমিটি, ইউএন সচিবালয়ে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল না। এ বিষয়ে আমরা দাবি জানিয়ে আসছিলাম। এবার আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। আমি বলব এটা একটা অগ্রগতি।
লস অ্যান্ড ড্যামেজের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বিবেচিত হওয়া উচিত সেগুলোও আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে।’
দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন মুকিত মজুমদার বাবু। তিনি বলছিলেন, ‘জলবায়ু দূষণ কমাতে না পারলে আমাদের প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। উন্নত দেশগুলোর কার্বন নির্গমন কমাতেই হবে। দেশের ভেতরে আমাদের যা করা দরকার সেটাও করতে হবে। গাছ কাটব, বন ধ্বংস করব, আর মুখে প্রকৃতি রক্ষার কথা বলব, তাহলে তো চলবে না। ভালো উদ্যোগ যে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থ থেকে তহবিল গঠন করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি কমাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই তহবিল থেকে দেশে যেসব প্রতিষ্ঠানকে অর্থ দেয়া হচ্ছে সেসব অনেক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে প্রশ্ন আছে। আপনারাও পত্রিকায় লিখেছেন। আমি পড়েছি। এখানে স্বচ্ছতা খুব জরুরি।’
বাংলাদেশ দল বেশ ভালো রকমের অগোছালো। কোন ইস্যুতে কী অবস্থান তা পরিষ্কার নয়, রীতিমতো কি বিভ্রান্তিকর। তাই বাংলাদেশের উচিত ছোট প্রতিনিধি দল নিয়ে সম্মেলনে যোগ দেয়া। ফলে নতুন সমঝোতাকারী অন্তর্ভুক্ত করা, প্রশ্নবোধক ব্যক্তিদের বাদ দেয়া, লিখিতভাবে দেশের অবস্থান পরিষ্কারও করা, সর্বত্র স্বচ্ছতা বজায় রাখা।
আন্তর্জাতিক সেমিনারে সুশীল সমাজের আহ্বান

জলবায়ু বাস্তুচ্যুতদের দায়িত্ব ধনী দেশগুলোকে নিতে হবে
ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার ১২টি আন্তর্জাতিক সুশীল সমাজ সংগঠনের নেটওয়ার্ক এবং বাংলাদেশের ৭টি নেটওয়ার্ক জলবায়ু বাস্তুচ্যুতদের দায়িত্ব ধনী দেশগুলোকেই নিতে হবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। কপ ১৮ উপলক্ষে আয়োজিত ‘জাতিসংঘের নতুন সনদ প্রয়োজন : জলবায়ু  বাস্তুচ্যুত: প্রসঙ্গ অধিকার ও দায়িত্ব’ র্শীষক এই  সেমিনারে দাবি করা হয় যে, ধনী দেশগুলোই জলবায়ু পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনের জন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ী। সেমিনারে অংশগ্রহণকারী  আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কগুলো হলো ৩৫০.ওআরজি (যুক্তরাষ্ট্র),  ভারতের বিয়ন্ড কোপেনহেগেন কালেকটিভ,  ভারতীয় জন বিজ্ঞান যাত্রা এবং পারিভি, ফিলিপাইনের জুবিলি সাউথ এশিয়া প্যাসিফিক ডেভেলপমেন্ট মুভমেন্ট (জেএসএপিএমডিডি) এবং পিপলস মুভমেন্ট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, কেনিয়ার প্যান আফ্রিকান ক্লাইমেট জাস্টিস এলায়েন্স (পিএসিজেএ), বেলজিয়ামের  লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি ওয়াচ,  নেপালের সাউথ এশিয়ান এলায়েন্স অন পোভার্টি ইরাডিকেশন (এসএএপিই), যুক্তরাজ্যের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট মুভমেন্ট এবং জুবিলি ডেভট ক্যাম্পেইন। বাংলাদেশি নেটওয়ার্কগুলো হলো বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ ইনডেজিনাস পিপল নেটওয়ার্ক ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড বায়ো ডাইভার্সিটি (বিপনেট সিসিবিডি), ক্লাইমেট চেঞ্জ ডেভলপমেন্ট ফোরাম (সিসিডিএফ), ক্লাইমেট গভর্নেন্স নেটওয়ার্ক (সিএফজিএন),  ক্যাম্পেইন ফর সাসটেইনেবল রুরাল লাইভলিহুড (সিএসআরএল), ইক্যুইটি এন্ড জাস্টিস ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইক্যুইটিবিডি) এবং নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট ক্লাইমেট চেঞ্জ বাংলাদেশ (এনসিসিবি)।
ড. আহসান উদ্দিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে বক্তব্য রাখেন পিএমসিসি’র ড. টনি ট্রোজান, পিএসিজেএ’র স্যামুয়েল ওগালহা, জুবিলি সাউথ ল্যাটিন আমেরিকা এবং বলিভিয়া’র মার্টিন ভিল্লেলা, জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের  ড. কোকো ওয়ার্নার, এসএএপিই’র ড. তিমসিনা নেত্রা, ভারতের সোমাইয়া দত্ত ও সঞ্চয় ভাহয়িস্ট, একশনএইড বাংলাদেশ’র ফারাহ কবির এবং বিসিএএস’র ড. আতিক রহমান। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিসিডিএফ’র গোলাম রাব্বানী। আয়োজকদের পক্ষ থেকে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইক্যুইটিবিডি’র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং সমাপনী বক্তব্য রাখেন সিএফজিএন’র জাকির হোসেন খান।
মূল প্রবন্ধে জাকির হোসেন খান জলবায়ু বাস্তুচ্যুতির উপর একটি বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেন। তিনি জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণরত প্রতিনিধিদের প্রতি কানকুন সমঝোতার ১৪ (এফ) প্যারা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান, যেখানে জলবায়ু বাস্তুচ্যুতদের কথা বলা হয়েছে।
ড. টনি ট্রোজান বলেন, হয় ইউএনএফসিসিসি অথবা জাতিসংঘের অধীনে নতুন একটি সনদ প্রয়োজন, যার মাধ্যমে সীমান্তবর্তী জলবায়ু বাস্তচ্যুতরা তাদের অধিকার পায়, কারণ জলবায়ু বাস্তুচ্যুতরা তাদের মানবাধিকার রক্ষায় একটি নতুন নিরাপদ আইনি কাঠামোর অধিকার রাখে। স্যামুয়েল ওগালহা বলেন, একটি মহাদেশ হিসেবে আফ্রিকা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচাইতে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন, অথচ এই অঞ্চলটি মাত্র ৪% কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী।  যেহেতু ধনী দেশগুলো কার্বন নির্গমন এবং জলবায়ুর সব ধরনের নেতিবাচক পরিবর্তনের জন্য দায়ী, এবং যেহেতু আরেকটি পৃথিবী তৈরি করা সম্ভব নয়, তাই জলবায়ু বাস্তুচ্যুতদের দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে। 
মার্টিন ভিল্লেলা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ইতোমধ্যে ল্যাটিন আমেরিকায় বাস্তচ্যুতিসহ নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। জলবায়ু আলোচনার ক্ষেত্রে মানবাধিকারের মূল নীতিগুলো বিবেচনা করতে হবে। আর  এ কারণেই এই পৃথিবীতে ঁেবচে থাকার নতুন উপায় প্রয়োজন। তিমসিনা নেত্রা বলেন, বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্ব নানাভাবে এই পৃথিবী এবং এর সম্পদের সর্বনাশ করছে, এবং এর সুফল ভোগ করছে ধনী দেশগুলো। এ কারণেই এই ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার,  চিন্তার নতুন মাত্রা প্রণয়ন অতি আবশ্যক।
ফারাহ কবির বলেন, ধনী দেশগুলোকে হয় ব্যাপকভাবে কার্বন নির্গমন কমাতে হবে, অথবা যারা বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে সেই সব মানুষের জন্য নতুন বিকল্প নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি জলবায়ু বাস্তুচ্যুতির ক্ষেত্রে জেন্ডারের সংবেদনশীলতার বিষয়টি আলোকপাত করেন।  ড. কোকো তার গবেষণার আলোকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রেক্ষিতে জলবায়ু বাস্তুচ্যুতির বিষয়টি তুলে ধরেন। সোমাইয়া দত্ত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভারতে কিভাবে জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি ঘটছে তা তুলে ধরেন। ড. আতিক রহমান বলেন,  সম্মেলনে আগত সকল প্রতিনিধিকেই মানুষের যে স্থানত্যাগ বা অন্যত্র স্থানান্তরের অধিকার রয়েছে তা তুলে ধরতে হবে।

No comments:

Post a Comment